আধুনিক বাঙলা কবিতা

View cart “কবিতাপুঞ্জ” has been added to your cart.

৳ 800.00

বিশ শতকের বাঙালির প্রতিভার মহত্তম সৃষ্টি আধুনিক বাঙলা কবিতা। শুধু বিশ শতকের নয়, হাজার বছরের বাঙলা কবিতার থেকে অভিনব ও উৎকৃষ্ট কবিতা লেখা হয়নি আর কোনো শতকে। মাত্র সাড়ে ছ-দশকে আধুনিক কবিতার যে-উৎপাদন ঘটে উৎকর্ষে ও পরিমাণে তার তুলনা দুর্লভ। আধুনিক বাঙলা কবিতা বিশ্বের অন্যান্য ভাষার আধুনিক কবিতার মতোই অভিনব ও বিস্ময়কর, এবং বিপর্যয়করও; তবে বিস্ময়ের মাত্রা বাঙলায় অনেক বেশি। আধুনিক বাঙলা কবিতার সাথে জড়িত একটি বিস্ময় হচ্ছে একই দশকে পাঁচজন মহৎ কবির আবির্ভাব, আগে যা কখনো ঘটেনি। আধুনিক বাঙলা কবিতায়ই প্রথম বাঙলা কবিতা হয়ে ওঠে প্রাপ্তবয়স্কতার কবিতা। এ-কবিতা বিশ শতকের কবিতা, এ-কবিতায়ই প্রকাশ পেয়েছে বিশ শতকের সংবেদনশীলতা, এতেই পাই বিশ শতকের আপন শিল্পকলা। আধুনিক বাঙলা কবিতা এক আন্তর্জাতিক প্রপঞ্চের বঙ্গীয় রূপ, ওই প্রপঞ্চের নাম আধুনিকতা বা আধুনিকতাবাদ, যার উদ্ভব ঘটে পশ্চিমে, এবং ছড়িয়ে পড়ে সারা পৃথিবীতে। আমাদের ভাগ্য যে বাঙলা ববিতা ওই প্রপঞ্চের বাইরে থাকে নি, বরং থেকেছে অত্যন্ত ভেতরে, এবং সুফল ফলিয়েছে কবিতার। রোম্যান্টিক আন্দোলনের পর সবচেয়ে ব্যাপক ও সফল সাহিত্যশিল্পান্দোলন আধুনিকতা বা আধুনিকতাবাদ, যা গ্রহ জুড়ে সৃষ্টি করেছে অভিনব অসামান্য সাহিত্য ও শিল্পকলা; তার অবসান ঘটে গেছে দু-তিন দশক আগে, তবে রোম্যান্টিকতাকে যেমন আমরা সম্পূর্ণ মুছে ফেলতে পারিনি, তেমনি এখনো আমরা বাস করছি আধুনিক সাহিত্যের মধ্যেই। আধুনিকতাবাদ এক বহুমাত্রিক শিল্পসাহিত্যান্দোলন, যার বিকাশ ঘটেছে নানা রূপে, নানা রীতিতে। ইংরেজি ‘মডার্ন’ আর বাঙলা ‘আধুনিক’ শব্দ দুটি আর্থগতিশীল, তা বিশেষ কোনো স্থির কাল নির্দেশ না করে যে-কালই আসে, নির্দেশ করে তাকেই; ‘অধুনা’ থেকে গঠিত ‘আধুনিক’ বোঝায় এখনকার সাম্প্র্রতিক তবে আধুনিকতাবাদ প্রত্যেক কালের বৈশিষ্ট্য নয়, বিশ শতকের বিশেষ সময়ে যে-প্রপঞ্চ দেখা দিয়েছিল, তাই আধুনিকতা বা আধুনিকতাবাদ। অন্যান্য কালের স্বভাবে রীতির এককতা, আর আধুনিকতার স্বভাব রীতির বৈচিত্র্য; তার কারণ আধুনিকতাবাদ একক আন্দোলন নয়, একরাশ আন্দোলনের-আমপ্রেশনিজম, অভিব্যক্তিবাদ, কিউবিজম, ভবিষ্যবাদ, প্রতীকবাদ, চিত্রকল্পবাদ, ভটিসিজম, দাদাবাদ, পরাবাস্তবতাবাদ ও আরো নানা শিল্পকলাবাদের সমষ্টি। এ-সব বাদের মধ্যে মিল রয়েছে এখনো যে প্রতিটি আন্দোলনই বাস্তবতাবাদ ও রোম্যান্টিকতাবিরোধী, ও বিমূর্ততামুখী; এ ছাড়া এগুলোর মধ্যে মিলের থেকে অমিল বেশি, এবং অনেকগুলো পরস্পররোধী।

এ-সংকলনের উদ্দেশ্য প্রথাগত কবিতা থেকে আধনিক কবিতা, এবং অকবিতা থেকে উৎকৃষ্ট কবিতা শনাক্ত করা। আধুনিক বাঙলা কবিতার প্রতিটি সংকলন দুটি ত্রুটি বহন করে থাকে; বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত আধুনিক বাংলা কবিতার, (১৯৫৪) মতো মিশ্রণ ঘটায় আধুনিক ও প্রথাগত কবিতার, বা এমন অনেকের কবিতা সংকলন করে, যাঁরা কবি নন। হুমায়ুন আজাদ সম্পাদিত এ-সংকলনটি আধুনিক এবং শুধুই আধুনিক কবিতার সংকলন, এবং এটি আধুনিক বাঙলা কবিতার ইতিহাস নয়, সমালোচনা ভ আধুনিক বাঙলা কবিতা সংকলন, এবং এটি আধুনিক বাঙলা কবিতার ইতিহাস নয়, সমালোচনা। আধুনিক বাঙলা কবিতা সংকলনের সম্পাদকেরা পরিচয় দিয়ে থাকেন দ্বিধা আর ভীরুতার; অনাধুনিক প্রথাগত কবিতাও তাঁর নেন আধুনিক কবিতার সংগ্রহে, সৃষ্টি করেন বিভ্রান্তি; আধুনিক কবিতা যে একটি স্বতন্ত্র কবিতাধারা, তা বুঝতে দেন না। বাঙলায় ১৯২৫ আধুনিকতাবাদের সূচনাবছর; আর কয়েক বছর পরই বেরোয় পরিপূর্ণ আধুনিক চেতনাসম্পন্ন কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ। বাঙলা কবিতায় রোম্যান্টিকতা দেখা দিতে লেগেছিল প্রায়-এক শতক, কিন্তু আধুনিকতাবাদ দেখা দেয় পশ্চিমের সাথে একই দশকে, প্রায়-অবিলম্বে। আধুনিকতাবাদের জন্যে পশ্চিমে আধশতক ধরে যে প্রস্তুতি চলেছিল, বাঙলায় তেমন কোনো প্রস্তুতি চলেনি; তাই বাঙলার আধুনিকতাবাদ পশ্চিমের থেকেও বেশি আকস্মিক ও বিপর্যয়কর। বিশের দশকে বাঙলা ভাষায় সূচনা ঘটে আধুনিক কবিতার, তিরিশের দশকে ফলে ওই কবিতার অতুলনীয় শস্য। পশ্চিমে আধুনিকতাবাদ যেমন সৃষ্টি করে অভিনব শিল্পকলা, অভিনবত্ব সঞ্চার করে শিল্পকলার সমস্ত শাখায়, বাঙলায় তা ঘটেনি; ঘটেছে প্রথাৎত বা একলা আধুনিক কবিতায়; আমাদের কবিরাই শুধু আয়ত্ত করতে পেরেছেন নতুন সংবেদনশীলতা, সৃষ্টি করতে পেরেছেন নতুন শিল্পকলা। পশ্চিমের মতো বাঙলা আধুনিক কবিতাও ভয়ংকর বদল ঘটায়। এ-কবিতা রাবীন্দ্রিক কবিতার স্বাভাবিক পরিণতি তো নয়ই, বরং এত ভিন্ন যে আজো এ-কবিতার অভিঘাত আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি; তাই আজো আধুনিক কবিতা এড়িয়ে প্রথাগত কবিতায়ই আমরা স্বস্তি খুঁজি। আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ও জীবন যেহেতু প্রথাগত, মধ্যযুগীয়, তাই রোম্যান্টিক ও প্রথাগত কবিতার মহিমায়ই আমরা আজো মুগ্ধ হয়ে আছি। আধুনিক বাঙলা কবিতা বাঙালির সংবেদনশীলতা বদলে দিতে চেয়েছে; তবে বাঙলা বদলায়নি, এমন অচল গোত্রকে শিল্পকলার সাহায্যে বদলানো অসম্ভাব। আধুনিকতা পূর্বক বাঙলা কবিতা সরল আবেগের কবিতা, কৈশোর বা প্রথম যৌবনের আবেগ, স্বপ্ন, কাতরতাই বিষয় প্রথাগত বাঙলা কবিতার; আর ওই কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে যে-অভিজ্ঞতা, তা সর্বজনীন অভিজ্ঞতা, তা শুধু কবির নয়, পাঠকেরও অভিজ্ঞতা। আধুনিক বাঙলা কবিতা সর্বজনীন সাধারণ অভিজ্ঞতার বদলে প্রকাশ করে কবির অনন্য ব্যক্তিগত অভিজ্হতা, যা অধিকাংশ সময়ই মানসিক; আর আধুনিক কবিরা তা প্রকাশ করেছেন অভিনব ভাষায় ও অলংকারে। এ-সংকলনে হুমায়ুন আজাদ কবিতানুরাগীদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন আধুনিক বাঙলা কবিতার শ্রেষ্ঠ রূপের সাথে; পৃথক করেছেন আধুনিক কবিতাকে প্রথাগত কবিতা থেকে, আর কবিতাকে অকবিতা থেকে।