ভাষা চিন্তা ও প্রক্রিয়া এবং একটি কবিতা

View cart “বিস্মরণের চাবুক” has been added to your cart.

৳ 50.00

সভ্যতার সূচনা থেকেই মানুষ বিমূঢ় বোধ করে এসেছে অসীম মহাবিশ্বের দিকে তাকিয়ে এবং বিস্ময় প্রকাশ করেছে তার হৃদয়লোক অবলোকন করে। এ-বিমূঢ়তা ও বিস্ময়বোধই মানুষকে জীবজগৎ থেকে পৃথক করেছে এবং উন্নীত করেছে যৌক্তিক প্রাণীতে। আদিকালে সে ছিল প্রায় অজ্ঞ ও বৌদ্ধিকতায় অন্ধ। কিন্তু মানুষ সৃষ্টিশীল ও মননশীল প্রাণী। ক্রমে সে তার বোধ, উপলব্ধি, পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণকে কীক্ষন ও শাণিত করেছে এবং বুঝতে চেষ্টা করেছে এ-মহাবিশ্বের অসীমতা ও হৃদয়লোকের গভীরতাকে। এর পরিণতিতেই সে সৃষ্টি করেছে অসাধারণ সব প্রপঞ্চ ও রচনারাশি। এসব প্রপঞ্চ ও রচনাকে আমরা প্রধানত ভাগ করতে পারি দুটি ভাগে। একটি দর্শন ও বিজ্ঞান এবং অন্যটি শিল্প ও সাহিত্য। প্রথমটি বাইরে থেকে বাইরে যায় এবং উদঘাটন ও বিশ্লেষণ করে বিশ্ব -প্রকৃতির মূর্ত ও বিমূর্ত সব সূত্র …পরিণামে সত্য; দ্বিতীয়টি ক্রমশই ভেতর থেকে আরো ভেতরে যায় এবং বিশুদ্ধ সৌন্দর্যের আকারে প্রকাশ করে মানুষের স্বপ্ন–কামনা-বাসনা ও আবেগ, তথা হৃদয়ের নানা চেতন ও অবচেতনিক স্বর, শেষত মানুষের প্রকৃতি- যার তীব্র ও চরম উৎসারণ আমরা প্রত্যক্ষ করি কবিতায়। এ-দুটি রূপের মধ্যে আপাতত বিসদৃশ্যতা মূর্তিমান হলেও, এদের মধ্যে রয়েছে গভীর মিলও। বোধের চূড়ান্ত ও তীব্র পর্যায়ে তা যেন এক হয়ে যায়। তখন keats-এর ভাষার :Beauty is truth & truth is beauty . ভাষাবিজ্ঞান ও শিল্প –সাহিত্যের এই উদ্ভব ও বিকাশ একমাত্র সম্ভ হয়েছে মানুষের সহজাত গুণে আর সেটি হচ্ছে ভাষা, যা ছাড়া সৃষ্টিশীলতা অন্ধ, মননশীলতা অস্তিত্বহীন। ভাষার মাধ্যমেই আমরা প্রকাশ করি বিশ্বসৃষ্টির তত্ত্ব, সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশ, মানুষের ইতিহাস, বিবতন, তার সামাজিক-রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক চালচিত্র। তাত্ত্বিক বিতর্কে প্রবেশ না করেও বলা যায়, চিন্তা প্রকাশের মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। ভাষা ও চিন্তার মধ্যে রয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও গভীর সম্পর্ক। চিন্তা বিমূত এবং ভাষা মূর্ত। ভাষা ও চিন্তা, তথা মূর্ত ও বিমূর্তের মধ্যে অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই আমরা প্রকাশ করি আমাদের বক্তব্য সঠিকভাবে উপস্থাপনের জন্য প্রয়োজন তাই চিন্তার স্বচ্ছতা ও ভাষার স্পষ্টতা। গত এক হাজার বছরের বাংলা কবিতার ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এ-ধরনের সংবেদনশীলতা ও ভাষিক পরিস্রুতি সবচেয়ে বেশি আয়ত্ত করতে পেছে আধুনিক বাংলা কবিতা, বিশেষত তিরিশের আধুনিক কবিতা  তার পরবর্তী পর্যায়ের বাংলাদেশের কবিতা, যা মূলত বাহ্য জীবনকে আশ্রয় করে বিকশিত, প্রায় প্রত্যক্ষভাবেই অনুসরণ করেছে তিরিশের সংবেদনশীলতা। এবং দুর্ভাগ্যের ব্যাপার এই যে,বাংলা কবিতা থেকে এখন আধুনিকতা প্রায় বিদায় নিয়েছে। এখন তো দিকে দিকে গৌণ কবি ও অকবিদের কলমে রচিত হচ্ছে অসংখ্য জীর্ণ, দূষিত, অশুদ্ধ, তুচ্ছ ও অতিশয় নিম্নমানের উন্মত্ত পঙক্তিমালা, যা কবিতার ছদ্মবেশে ভারাক্রান্ত করে তুলছে বাংলা কবিতা এবং দূষিত করে তুলেছে বাংলার কবিতাকাশ। এটি বিশ শতক নয়, একবিংশ শতাব্দী। এই শতাব্দীর ঊষালগ্নে অজস্র তুচ্ছ ও জীর্ণ পঙক্তিমালার পরিবর্তে আমরা কি আশা করতে পারি না একগুচ্ছ মৌলিক কবিতা, যা আমাদের ভাষাকে পরিস্রুত করবে, চেতনাকে শাণিত করবে, সমৃদ্ধ করবে বাংলা কবিতাকে, সর্বোপরি, নতুন করে স্বপ্ন দেখাবে বাংলা কবিতা বিষয়ে? আমাদের এই স্বপ্নর্দ্র কামনা ও বাসনার বিচ্ছুরণ লক্ষ করি তরুণতম কবি সায়মন রিয়ানের দার্শনিক বোধের জারকে জারিত এই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতার পরতে–পঙক্তিতে। এ-কবিতারাশির উদ্ভব ব্যক্তির সঙ্গে বিশ্ব-প্রকৃতির আত্মিক স্পর্শে ও সংশয় তাই এসব কবিতা তথাকথিত নিঃসাড়, নিষ্ফল কবিতার নামে কেবল পঙক্তির পর পঙক্তি ক্লান্তিকর বিন্যাস নয় বরং বিশ্ব-প্রকৃতি, বস্তুজগৎ, প্রেম-ভালোবাসা এবং ব্যক্তিক দ্বন্দ্ব-সংশয়-সংক্ষোভ-সিক্ত তাঁর একান্ত জীবনদর্শন ও  দার্শনিকতার নির্যাস। এবং কোনোক্রমেই তা বিশুদ্ধ শিল্পকলা ও নান্দনিকতাকে বিসর্জন দিযে নয় বরং একে কেন্দ্র করেই রচিত। উপরন্তু বাংলা কবিতা থেকে যখন দর্শনের শেকড় উৎপাটিত, রিয়ান সেখানে ধ্রুবার্থে শুধু কবিই নন, কবি-দার্শনিকও। তাঁর এই গ্রন্থধৃত কবিতাবলি তাই দর্শনের কবিতা কিংবা কবিতার দর্শন। অসাধারণ গদ্যে ও অভিনব ছন্দে রচিত রিয়ানের কবিতা একবিংশ শতাব্দীরই কবিতা- যা হয়তো পরবর্তী মহৎ কবিদের সৃষ্টিশীলতা ও মননশীলতার জন্য উৎস হিসেবে ভূমিকা রাখবে। রিয়ানের জন্ম ১৯৮০ সালে। বাংলাদেশে। প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শেষে এখন তিনি উচ্চশিক্ষা ব্যপদেশে কানাডা প্রবাসী। গণিত ও  দর্শন তাঁর অধীত বিষয়।