রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রধান কবিতা

৳ 600.00

হুমায়ুন আজাদ বলেছেন প্রস্তুত হচ্ছি যখন পঞ্চাশ হওয়ার জন্যে, এবং খুব সুখী বোধ করতে পারছি না তখন ঘটলো এ অসামান্য অভিজ্ঞতাটি।ধীরশান্তভাবে প‘ড়ে উঠলাম তাঁর চার হাজারের মতো কবিতা ও গান; মনে হলো ধন্য হচ্ছে আমার ভোর, দুপুর, সন্ধ্যা, রাত্রিগুলো; আমার মেঘ, শিউলি, জ্যোৎস্না, কঅন্ধকার; আমার প্রত্যেক মুহূর্ত, প্রতিটি তুচ্ছ বস্তু। পড়ছিলাম ও অনুভব করছিলাম ঢুকছি আদিগন্ত ছড়ানো সমভূমিতে, যেখানে বাস করে এক বিস্ময়কর প্রাণী, মানুষ; যেখানে ঋতুর পর ঋতু আসে, ফুল ফোটে রঙিন ও সুগন্ধি হয়ে, পাতা সবুজ হয়, এক সময় ঝ‘রে পড়ে, যেখানে নদী বয়, আকাশ জুড়ে মেঘ ঘনিয়ে আসে। যতোই পড়ছিলাম তাঁর কবিতা, সহজ হয়ে উঠছিল আমার নিশ্বাস, সজীব হয়ে উঠলিলো ইন্দ্রিয়গুলো।তিনি কোনো ‘সংবর্ত’ বা ‘অকেস্ট্রা’ বা ‘যযাতি’ বা ‘উটপাখি’ বা ‘বোধ’ বা অন্ধকার’ বা ‘আট বছর আগের একদিন’ বা ‘আদিম দেবতারা’ লেখেন নি; লিখেছেন ‘নির্ঝরের স্বপ্ন’, ‘বধূ’, ‘অনন্ত প্রেম’, ‘মানসসুন্দরী’, ‘ এবার ফিরাও মোরে’, ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’, ‘স্বপ্ন’, ‘পুরস্কার’, ‘বিদায়-অভিশাপ’, ‘শেষ বসন্ত’। তাঁর কবিতা পড়ছিলাম সুখে; কিছুই বুঝে নেয়ার জন্যে চেষ্টা করতে হচ্ছিলো না, যেমন শিউলি বা বৃষ্টি বা হাহাকার বুঝে নেয়ার জন্যে চেষ্টা করি না আমরা, ওগুলো বোঝার অনেক আগোই হৃদয়ে সংক্রামিত হয়; আলোড়িত হচ্ছিলাম, আমার অনুভূতিকোষে ঝ‘রে পড়ছিল প্রকৃতি ও প্রেমিকের আবেগ। তাঁর কবিতা ও গানগুলো প‘ড়ে মনে পড়ছিল তাঁরই কয়েকটি পঙক্তি। পৌরাণিক এক পুরুষকে মনে রেখে তিনি একবার প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কে পেয়েছে সবচেয়ে, কে দিয়েছে তাহার অধিক? তাঁর কবিতা পড়তে পড়তে আমার মনে হ‘তে থাকে ওেই পুরুষ কোনো পৌরাণিক পুরুষ নন, রাজা নন; তিনি কবি, কবিদের রাজা, তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ। তাঁর মতো আর কেউ পায় নি, তাঁর মতো আর কেউ দেয় নি।

বিশ্বের মহত্তম রোম্যান্টিকদের একজন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর মধ্যে পাই রোম্যান্টিসিজমের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ, যা পাই না আর কারো মধ্যে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র, মৌলিকত্ব, কল্পনাপ্রতিভা, স্বতস্ফূর্ততা, আবেগানুভূতি যেমন ব্যাপক, গভীর, তীব্রভাবে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কবিতা ও গানে, তা আর কোথাও হয়নি। বিলেতের পাঁচ রোম্যান্টিক মিলে যা ক‘রে গেছেন, বাঙলায় একলা তিনি করেছেন তার চেয়ে অনেক বেশি। এক বহিরস্থিত রোম্যান্টিকরূপে শুরু হয়েছিল তাঁর; এক বাঁশিঅলারূপে নিজেকে দেখেছেন তিনি চিরকাল, মধ্যাহ্নের অলস গায়কের মতো বাঁশি বাজানোই যাঁর আনন্দ। কিন্তু তিনি নিয়ন্ত্রিত করছেন আজো আমাদের স্বপ্ন ও সভ্যতা। যেদিন স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল নির্ঝরের সেটা ছিল মানুষের জন্যে এক মহাশুভদিন। ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটি তাঁর ইশতেহারের মতো; এতে তিনি যা কিছু ঘোষণা করেছেন, সারাজীবন বাস্তবায়িত ক‘রে গেছেন তাই। গুহার অঁধারে রবির করা আর প্রভাতপাখির গান পৌঁছোনোর পর ওই যে প্রাণ জেগে উঠলো, থর থর ক‘রে কাঁপতে শুরু করলো ভূধর, তা আর থামে নি; সারাজীবন তিনি ঢেলে চললেন করুণাধারা, ভেঙে চললন পাষাণকারা, জগৎ প্লাবিয়া গেয়ে চললেন গান, ঢেলে দিতে লাগলেন প্রাণ, আর দিকে দিকে ভ‘রে উঠতে লাগলো বাঙলা কবিতা। তাঁর কবিতা এক বিশাল বা অসীম মানবিক ভুবন, যা তীব্রতম আবেগে আলোড়িত। অবলীলায় যেমন তিনি লিখেছেন অজস্র বিশুদ্ধ কবিতা, তেমনি লিখেছেন আটপৌরে কাহিনী; লিখেছেন ব্যঙ্গ কবিতা, নীতিকথা, পৌরাণিক উপাখ্যান, ছোটোদের কাহিনী; লিখেছেন ব্যঙ্গ কবিতা, নীতিকথা, পৌরাণিক উপাখ্যান, ছোটোদের জন্যে কবিতা, এবং কী নয়। তাঁর কবিতায়ও প্রধান প্রেম; শুধু তাই নয়, এমন তীব্র কাতর নিরন্তর অহমিকাহীন নিবেদিত প্রেমিক বাঙলায় আর জন্মে নি। সব মিলে তিনি এমন তীব্র কাতর নিরন্তর অহমিকাহীন নিবেদিত প্রেমিক বাঙলায় আর জন্মে নি। সব মিলে তিনি এমন মহান কবি, যিনি তাঁর সীমাবদ্ধ জাতিকে দিয়ে গেছেন অসীমাবদ্ধতার স্বাদ। তিনি মহাকবি, তাঁর মতো আর কেউ নেই। বিশশতকের শেষ দশকে হুমায়ুন আজাদ, এ-সময়ের প্রধান বহুমাত্রিক প্রতিভা, সম্পাদনা করলেন বাঙলার চিরকালের শ্রেষ্ঠ বহুমাত্রিক প্রতিভার কবিতা; এটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে বাঙলা কবিতার ইতিহাসে।